সমতলের ত্রিপুরাদের অবস্থা: একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা
শক্তিপদ ত্রিপুরা
সূচনা: ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের পাহাড় ও সমতল উভয় অঞ্চলে বসবাস করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা এবং সমতলের কুমিল্লা, চাঁদপুর, রাজবাড়ী, সিলেট, চট্টগ্রাম বিভাগের ফটিকছড়ি, মিরসরাই, ছোট কুমিরা, বড় কুমিরা, সীতাকুন্ডু প্রভৃতি এলাকায় বসবাস করে। সমতল এলাকার ত্রিপুরাদের জনসংখ্যা পঞ্চাশ হাজারের কাছাকাছি হবে। আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে একমাত্র ত্রিপুরা আদিবাসী পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সমতলের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এর প্রধান কারণ হলো এক সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম ও উল্লেখিত সমতলের অঞ্চলসমূহ ত্রিপুরা মহারাজার রাজ্যভূক্ত ছিলো। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সমতলের বিভিন্ন অঞ্চলে এখনো ত্রিপুরা মহারাজাদের স্থাপত্য কালের স্বাী হয়ে আছে। এগুলোর কোন কোন স্থাপত্য ইতোমধ্যে প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে আবার কোন কোনটি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের দখলে। আবার কোন কোনটি যত্নের অভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছে।
সার্বিক অবস্থা
সমতলের ত্রিপুরাদের সার্বিক অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। এ জনগোষ্ঠীর বেশীরভাগ পরিবার ভূমিহীন। ছলে বলে কৌশলে তাদের পিতৃভূমি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বেদখল করে নিয়েছে। এ জনগোষ্ঠীর স্বারতার হার অত্যন্ত কম। তাদের আর্থিক অবস্থা বিষম খারাপ। এ জনগোষ্ঠীর বেশীরভাগ লোক অন্যের নিকট শ্রমিক হিসেবে কাজ করে জীবন ধারণ করে। সমতলের কোন কোন অঞ্চলের ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর লোকেরা তাদের ভাষা ও পোষাক হারাতে বসেছে। চাঁদপুর ও কুমিল্লার ত্রিপুরা রমণীরা এখন নিজস্ব পোষাক 'রিনাই-রিসা' পরিধান করে না। তারা এখন শাড়ী ব্যবহার করে। কোন কোন অঞ্চলের কিছু কিছু ত্রিপুরাদের হাতে কিছু কিছু জমি রয়েছে। সেসব জমি হাতিয়ে নেয়ার জন্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ভূমি দস্যুরা নানান ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। এসব ভূমিদস্যুরা আদিবাসীদের বিরুদ্ধে হয়রানীমূলক মামলা রুজু করছে। এ মামলার কারণে আদিবাসীরা আর্থিক ও মানসিকভাবে তির শিকার হচ্ছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর মানুষ কর্তৃক আদিবাসী নারীরা প্রতিনিয়ত ধর্ষণ ও নানান ধরণের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। নানান ধরণের ষড়যন্ত্র ও প্রলোভনের আশ্বাস দিয়ে আদিবাসীদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করতে যাতে তারা আদিবাসীদের জমি হাতিয়ে নিতে পারে।
চাঁদপুর, কুমিল্লা, রাজবাড়ী
ভূমি- কুমিল্লার ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী তাদের ভিটেমাটি থেকে বার বার উচ্ছেদ হয়েছে। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট, বার্ড ও বন বিভাগ কর্তৃক তথাকথিত বনায়নের জন্য তাদের নিজ ভিটেমাটি ও পিতৃভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে।
চাঁদপুরের ত্রিপুরারাও বিভিন্ন কারণে তাদের ভিটেমাটি হারিয়েছে। ১৯৪৭ ও ১৯৭১ সালে তারা বেশী বেশী করে তাদের জায়গা জমি হারিয়েছে। ১৯৭১ সালে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে পালিয়ে গিয়েছিলো। ভারত থেকে ফিরে এসে তারা আর তাদের জায়গা ফিরে পায়নি। তাদের জায়গা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ভূমিদস্যুরা বেদখল করে নিয়েছে। বন্যা, ঘুর্নিঝড় ইত্যাদির কারণেও চাঁদপুরের ত্রিপুরারা তাদের জায়গা জমি হারিয়েছিলো। বর্তমানে চাঁদপুরের বেশীরভাগ মানুষ ভূমিহীন। এদের বেশীরভাগ দিনমজুর। কুমিল্লা ও চাঁদপুরের ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর লোকেরা প্রাতিষ্ঠানিক শিা গ্রহণ শুরু করেছে। একটি ুদ্র অংশের মাঝে শিা চেতনা এসেছে। তবে জনগোষ্ঠীর মাঝে এ শিা চেতনা সামগ্রিকভাবে আসেনি। শিা গ্রহণের েেত্র চাঁদপুর ও কুমিল্লার ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর জন্য অর্থনৈতিক সমস্যা একটি বড় সমস্যা। আর্থিক সমস্যার কারণে ত্রিপুরা আদিবাসী শিশুরা শিার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সরকার সবার জন্য শিা ঘোষণা করলেও কুমিল্লা, চাঁদপুর ও রাজবাড়ী এলাকার ত্রিপুরা আদিবাসী শিশুরা সরকারের এই কর্মসূচীর বাইরে থেকে যাচ্ছে। রাজবাড়ী এলাকার ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর লোকেরা নিরাপত্তার অভাব এবং নানান আগ্রাসন ও নির্যতনের কারণে এদের বেশীরভাগ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে চলে গেছে।
সীতাকুন্ডু, মীরসরাই ও কুমিরা
এসব অঞ্চলের ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর লোকেরা সবচেয়ে করুণ। এদের বেশীরভাগ বর্তমানে কেউ বন বিভাগের জায়গায় কিংবা অন্যের লীজকৃত ভূমিতে বসবাস করছে। অথচ বন বিভাগ ও ব্যক্তি মালিকানাধীন এসব ভূমি ত্রিপুরা আদিবাসীরাই বনের বাঘ-ভল্লুক ও নানা রকম জীবজন্তুর সাথে যুদ্ধ করে, বহু শ্রম ও ঘামের বিনিময়ে সেসব ভূমিকে চাষযোগ্য ও বাসযোগ্য করে তুলেছিলো। তারা এসব অঞ্চলে গ্রাম গড়ে তুলেছিলো। এসব অঞ্চল ছিলো তাদের চাষযোগ্য জুমভূমি। যুগ যুগ ধরে তারা সেসব ভূমির উপর জুমচাষ করে আসছিলো। ত্রিপুরা আদিবাসীদের সরলতার সুযোগে বন বিভাগ ও সে অঞ্চলের ভূমি দস্যুরা আদিবাসীদের জুমভূমি ও গ্রাম লীজ নিয়ে নেয়। প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে বহু ঘাম, শ্রম ও জীবনের বিনিময়ে যে জমিগুলিকে চাষযোগ্য ও বাসযোগ্য করে তুলেছিলো এবং যে জায়গায় এই আদিবাসীরা যুগ যুগ ধরে জুমচাষ করে আসছিলো ও গ্রাম গড়ে তুলেছিলো সেসব জায়গা বন বিভাগ ও ভূমিদস্যুরা মতা অপব্যবহার করে অন্যায়ভাবে আদিবাসীদের ভূমি কেড়ে নেয়। বর্তমানে এসব আদিবাসীরা তাদের ভোগদখলীয় জায়গায় চাষাবাদের জন্য এবং নিজ গ্রামে বসবাসের জন্য জমির মালিককে অর্থ দিতে হয় এবং জমির মালিক কম পারিশ্রমিকের বিনিময়ে গ্রামবাসীকে বাধ্যগতভাবে শ্রম খাটায়। এসব অঞ্চলের ত্রিপুরা আদিবাসীদের উপর আধুনিক দাসব্যবস্থা চালু রেখেছে জমির মালিকেরা। বর্তমানে মীরসরাই- এর একটি গ্রাম ভূমি দস্যুরা উচ্ছেদ করতে চাচ্ছে। সেসব ভূমিদস্যু ইদানীং আদিবাসীদের গ্রামসুদ্ধ জমি বন্দোবস্ত নিয়েছে বলে দাবী করছে। এভাবে বর্তমান সময়েও ভূমিদস্যুরা ত্রিপুরা আদিবাসীদের নিজ ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ত্রিপুরা আদিবাসীদের তাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করার নানা ধরণের মিথ্যা মামলা দিয়ে আর্থিক ও মানসিকভাবে হয়রানী চালিয়ে যাচ্ছে। এ ধরণের মামলা, হয়রানী ও শারিরীক আক্রমনের কারণে ইদানীং কুমিরা ও, সীতাকুন্ড ও মিরসরাই থেকে বেশকিছু পরিবার অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। এ অঞ্চলে ত্রিপুরা আদিবাসী নারীদের উপর চলছে নানান ধরণের নির্যাতন। এসব অঞ্চলে আদিবাসী নারীরা প্রায়শ:ই ধর্ষণের শিকার হন। সীতাকুন্ডু, কুমিরা ও মিরসরাই অঞ্চলে ত্রিপুরা আদিবাসীর জনসংখ্যা আনুমানিক----- হবে বলে এলাকাবাসী দাবী করে।
সিলেট
সিলেট অঞ্চলের ত্রিপুরা আদিবাসীরাও বার বার তাদের পিতৃভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়েছে। এই অঞ্চলে ইস্পাহানী চা কোম্পানীসহ বেশ কয়েকটি চা কোম্পানী ত্রিপুরা আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে যুগ যুগ ধরে ভোগ দখলকৃত জুমভূমির উপর চা বাগান সৃজন করে। বন বিভাগ কর্তৃকও ত্রিপুরা আদিবাসীরা উচ্ছেদের শিকার হয়। বন বিভাগ ত্রিপুরা আদিবাসীর হাজার হাজার একর জুমভূমি বেদখল করে সে অঞ্চলের বন ধ্বংস করে বনবাগান গড়ে তুলে। বর্তমানে সিলেট অঞ্চলের বেশীরভাগ ত্রিপুরা ভূমিহীন ও বর্তমান বন বিভাগের জায়গায় ফরেষ্ট ভিলেজার হিসেবে বসবাস করছে। এসব অঞ্চলে কোন স্কুল নেই। তাই এসব অঞ্চলে ত্রিপুরা আদিবাসী শিশুরা শিার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে। তথাপি কয়েকটি গ্রামে যারা নিজস্ব ভিটেমাটি ও জমি আছে তারা তাদের সন্তানদের পড়াশুনা করাচ্ছে। যেহেতু বেশীরভাগ মানুষের আর্থিক অবস্থা নাজুক, তাই বেশীরভাগ সন্তান শিার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ অঞ্চলেও ভূমিদস্যুরা ত্রিপুরা আদিবাসীদের জায়গা জমি কেড়ে নেওয়ার জন্য নানা ধরণের ষড়যন্ত্র ও হয়রানীমূলক অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। গ্রামের যারা একটু সচেতন ও সংগঠক তাদের বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যা মামলা দিয়ে অযথা হয়রানী করা হচ্ছে।
ইতিহাস ও ঐতিহ্য
কুমিল্লা শহরে ত্রিপুরা মহারাজাদের বহু ঐতিহাসিক নিদর্শন এখনো কালের সাী হয়ে আছে। ত্রিপুরা মহারাজার আমলে কুমিল্লার নামও 'ত্রিপুরা'। পাকিস্তান আমলে ত্রিপুরা- এর পরিবর্তে জেলার নাম 'কুমিল্লা' রাখা হয়। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টকে ঘিরে বর্তমানে যে বাজারটি ক্যান্টনমেন্ট মার্কেট নাম ধারণ করেছে পূর্বে সেই মার্কেটের নাম ছিলো 'টিপরা বাজার'। আশির দশক অবধি এই মার্কেটের নাম ছিলো 'টিপরা বাজার'। আশির দশক পরে বাজারের নাম পরিবর্তন করা হয় এবং এর নাম রাখা হয় 'ক্যান্টনমেন্ট মার্কেট'।
টিপরা বাজার থেকে কিছুদূর গেলে সাবের বাজার। সাবের বাজারের উত্তর-পশ্চিম দিকে রানী ময়নামতির প্রাসাদ। রানীর বাংলো ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। তবে সুস্পষ্ট চিহ্ন এখনো য়ে গেছে। মাটি অবধি ইটের দেয়াল এখনো বর্তমান। বিরাট এলাকা নিয়ে রানীর বাংলো নির্মিত। চারিদিক ইটের দেয়াল এখনো রয়ে গেছে।
বাংলোর ভেতরে এক সুড়ঙ্গ ছিলো বলে জানা যায়। তবে, সুড়ঙ্গ কতদুর গেছে এবং সুরঙ্গ দিয়ে বের হবার পথ কেউ বের করতে পারেনি। আগরতলার রাজপ্রাসাদেও সুরঙ্গ পথ ছিলো। আক্রান্ত হলে যাতে নিরাপদে রাজা-রানী বের হয়ে যেতে পারে। সরকার ময়নামতি রানীর বাংলোকে প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। এই বাংলোর সামনে বিশাল একটি মাঠ আছে। এই মাঠে প্রতি বছর মেলা বসে। তবে, বাংলোটি যথাযথ সংরণের অভাব রয়েছে। মেলা শেষ হলে মাঠে সারাদিন গরু ছাগলের অভয়ারণ্য হয়ে থাকে।
রানীর বালোর নীচে দুটি দীঘি রয়েছে। জনশ্রুতি আছে- ময়নামতি ছিলেন যেমনি অতীব অপরূপ সুন্দরী তেমনি ছিলেন বুদ্ধিমতী। রানী ময়নামতি ঘোষণা দিলেন- এক রাতের মধ্যে যে এক বড় দীঘি খনন করে দিতে পারবে তাকে তিনি বিয়ে করবেন। বহু দেশীয় রাজা চেষ্টা করলেন কোন রাজাই এক রাতের ভেতরে দীঘি খনন করে দিতে পারেনি। ঢেউ রাজা ছিল দৈত্য রাজা। তিনি তাঁর হাজার হাজার দৈত্যদের নিয়ে পুকুর খনন খনন শুরু করলেন। রানী ময়নামতি দেখলেন- দৈত্য রাজা কয়েক ঘন্টার মধ্যে পুকুর খনন শেষ করতে চলেছে। তিনি এক ফন্দি আঁটলেন। তিনি নিজেই মোরগ ঠিক যেমনি ডাক দেয় অনুরূপ ডাক দিলেন। দৈত্যরা মনে করলো- ভোর হয়ে এলো। পুকুর খনন শেষ করা যাবে না। তাই তারা কোদাল পরিস্কার করে চলে গেলো। যেখানে কোদাল পরিস্কার করা হলো সে জায়গাটিও একটি পুকুর হয়ে গেলো এবং তার নাম হলো কোদাল্যা দীঘি। ঢেউ রাজা কর্তৃক খননকৃত বলে অপর দীঘিটির নাম হলো ঢেউ দীঘি। এই হলো ঢেউ দীঘি ও কোদাল্যা দিিঘর ইতিহাস।
আজ থেকে ৫০০ বছর আগে ত্রিপুরা মহারাজা বর্তমান কুমিল্লা শহরের প্রাণ কেন্দ্রে মহারাজা ধর্ম মানিক্য রানীরকুঠি নির্মাণ করেছিলেন। মহারানী কুমিল্লা অবস্থানকালে যাতে সানন্দে অবকাশ যাপন করতে পারে সে ল্েয ত্রিপুরা মহারাজা ধর্ম মানিক্য এ কুঠি নির্মাণ করেছিলেন। ১৯৪৯ সাল অবধি ত্রিপুরা মহারানীগণ কুমিল্লায় আগমন করলে এ কুঠিতেই অবস্থান করতেন। মহারাজাদের শাসনামল থেকে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর লোকেরা কুমিল্লা অঞ্চলে বসবাস করে আসছে। এখনো বহু ত্রিপুরা গ্রাম আছে যারা বংশ পরম্পরায় যুগ যুগ ধরে কুমিল্লা জেলায় বসবাস করে আসছে। কুমিল্লা জেলার এ ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী তাদের জায়গা জমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে বর্তমানে কঠিন বাস্তবতায় দিনাতিপাত করছে। ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করে কুমিল্লার বর্তমান বার্ড ও ক্যান্টনমেন্ট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এভাবে কুমিল্লার বেশীরভাগ ত্রিপুরা পিতৃভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে বর্তমানে ভূমিহীন অবস্থায় মানবেতর জীবন যাপন করছে।
কুমিল্লার ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী শিা-দীা ও অর্থনীতিতে খুবই অনুন্নত। অথচ ত্রিপুরা মহারাজারা কুমিল্লার সকল ধর্মের ও জাতির শিা, ভাষা ও সাহিত্য উন্নয়নে বহু উন্নয়নমূলক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। ত্রিপুরা মহারাজারা মধ্য যুগ থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য উন্নয়নে বহুভাবে ভূমিকা পালন করেছিলেন। সে সময়কালে রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর ও জগদীশ চন্দ্র বসুসহ বহু সাহিত্যিক ও গবেষক এবং শিা প্রসারের বহু উদ্যোগকে ত্রিপুরা মহারাজারা ফি বছর সহযোগিতা প্রদান করেছিলেন। সেই শিা ও সাহিত্য অনুরাগী অসাম্প্রদায়িক মহারাজাদের বংশধর কুমিল্লায় বসবাসকারী ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর লোকেরা আজ তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি হারাতে বসেছে। তাদের অস্তিত্ব আজ বিপন্ন। তাদের জায়গায় বহু উন্নয়ন হয়েছে; কিন্তু, এ জনগোষ্ঠীর কোন উন্নয়ন ঘটেনি।
আজ কুমিল্লার ত্রিপুরা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষা, সংস্কৃতি ও অস্তিত্ব ধ্বংসের পথে। কুমিল্লার আদিবাসীদের নামে যেসব বরাদ্ধ হয় তা অনেক সময় অ-আদিবাসীদের নামে প্রদান করা হয়। বাংলাদেশের ত্রিপুরা আদিবাসীদের ঐতিহ্য ও ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহ বিগত সময়ে সরকারের অবহেলার কারণে কোনটি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দখল করে নিয়েছিলো আবার কোনটি ধ্বংস প্রাপ্ত হয়েছিলো। আমরা বর্তমান সরকারের কাছে দাবী জানাই যাতে সরকার বাংলাদেশে ত্রিপুরা আদিবাসীদের যে সব ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রয়েছে সে সব নিদর্শন সংরণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ত্রিপুরা মহারাজাদের নির্মিত কুমিল্লার ঐতিহাসিক নিদর্শনসমূহ দেশের জাতীয় সম্পদ। এ ঐতিহাসিক জাতীয় সম্পদ সংরণে জাতির দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। এসব ঐতিহাসিক নিদর্শন সংরণ করা গেলে দেশের ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ সমৃদ্ধি হবে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ২৪ অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে " বিশেষ শৈল্পিক কিংবা ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্পন্ন বা তাৎপর্যমন্ডিত স্মৃতি নিদর্শন, বস্তু বা স্থান সমূহকে বিকৃতি, বিনাশ বা অপসারন হইতে রা করিবার জন্য রাষ্ট্র ব্যবস্থা গ্রহন করিবেন''। তাহলে কেন রানী কুঠির সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের নিকট হস্তান্তর হবেনা?
এসব ঐতিহাসিক নিদর্শন ছাড়াও কুমিল্লা শহরে ত্রিপুরা মহারাজাদের বহু প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ রয়েছে। এগুলো হলো- ১. বীরচন্দ্র গণ পাঠাগার ও নগর মিলনায়তন, ২. শাহসুজা মসজিদ, ৩. ত্রিপুরা ব্রম্ম মন্দির, ৪. রাজবাড়ী, ৫. শ্রী শ্রী রাজ রাজেশ্বরী মন্দির, ৬. দীঘি
ত্রিপুরা ব্রম্ম মন্দির ত্রিপুরা মহারাজা কর্তৃক নির্মিত একটি সনাতনী মন্দির। ১৯২৩ খ্রী: এই মন্দিরটি নির্মিত বলে জানা যায়। এটি বর্তমানে কুমিল্লা শহরের বাদুরতলায় অবস্থিত।
শাহসুজা মসজিদ বর্তমানে কুমিল্লা শহরের মোঘলতলীতে অবস্থিত। বহু মোঘল সম্রাটের সাথে ত্রিপুরা মহারাজার যুদ্ধ সংঘটিত হলেও সম্রাট শাহ সুজার সাথে ত্রিপুরা মহারাজার সম্পর্ক স্থাপিত হয়। বন্ধুর নিদর্শন স্বরূপ ত্রিপুরা মহারাজা এই শাহ সুজা মসজিদ নির্মাণ করেন।
কুমিল্লার ত্রিপুরা রাজার 'রাজবাড়ী' বর্তমানে 'কুমিল্লা জেলা ভূমি অফিস' হিসেবে ব্যবহ্নত হচ্ছে। এলাকার মানুষের কাছে এটি এখনো রাজবাড়ী হিসেবে পরিচিত। কুমিল্লা জেলা সাইবোর্ডে লেখা আছে রাজবাড়ী কম্পাউন্ড অর্থাৎ এই জায়গাটি এখনো রাজবাড়ী কম্পাউন্ড হিসেবে পরিচিত।
'শ্রী শ্রী রাজ রাজেশ্বরী কালী মন্দির' কুমিল্লা শহরের মনিহরপুরে অবস্থিত। ত্রিপুরা মহারাজ রত্ন মানিক্য ১১১৩ ত্রি: / ১৭০২ খ্রী: এই মন্দির নির্মাণ করেন।
'বীরচন্দ্র গণ পাঠাগার ও নগর মিলনায়তন' ১৮৮৫ খ্রী: নির্মিত। মহারাজা বীরচন্দ্র মানিক্য কর্তৃক নির্মিত বলেই এই গণ পাঠাগার ও নগর মিলনায়তনের নামকরণ হযেছে- বীরচন্দ্র গণ পাঠাগার ও নগর মিলনায়তন। এটি কুমিল্লা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত। কুমিল্লা জেলায় ত্রিপুরা রাজাদের এ ধরণের বহু ঐতিহাসিক স্থাপত্য রয়েছে।
সিলেটের শ্রীমঙ্গল শহরের ৫ কিলোমিটার দুরে নির্মাই শিবমন্দির ও এক বড় দীঘি আছে। এই শিব মন্দির ১৪৫৪ খ্রীষ্টাব্দে নির্মান করা হয়। ত্রিপুরা মহারাজা এই নির্মাই শিব মন্দিরটি নির্মাণ করেন ও মন্দিরের পার্শ্বস্থ দিিঘ খনন করেন সাধারণ জনগণের সুবিধার্থে।
নির্মাই শিব মন্দিরের ইতিহাস এই- ত্রিপুরা মহারাজার বিরুদ্ধে কখনো কখনো কুকি সামন্ত রাজা বিদ্রোহ ঘোষণা করতো। এরকম এক কুকি বিদ্রোহের সংবাদ পেয়ে একদল সৈন্য পাঠান কুকি বিদ্রোহ দমন করতে। তুমুল এ যুদ্ধে কুকিরা পরাজিত হলেও ত্রিপুরা রাজার সেনাপতি যুদ্ধেেত্র মারা যান। বিয়ের অল্প ক'বছরের মধ্যে স্বামী হারা হন রাজকন্যা নির্মাই। তখনকার দিনে ভারতবর্ষে সহমরণ প্রথা চালু ছিল। রাজকন্যা নির্মাই সহমরণে রাজি হননি। বরং তিনি যে স্থানে স্বামী মারা গেছেন সেস্থানে শিবের আরাধনা শুরু করেন। এ আরাধনায় তিনি সিদ্ধিলাভ করেন। ত্রিপুরা মহারাজা রাজকন্যা নির্মাই- এর এ আরাধনাকে স্মরণীয় করে রাখার ল্েয এ স্থানে শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন এবং মন্দিরের পাশে খনন করেন এক বিরাটকায় দীঘি।
সমতল এলাকার ত্রিপুরাদের আনুমানিক জনসংখ্যা
অঞ্চলের নাম জনসংখ্যা
ফটিকছড়ি অঞ্চল ১৫,০০০
কুমিরা, সীতাকুন্ডু ও মিরসরাই ১০,০০০
কুমিল্লা, চাঁদপুর ও রাজবাড়ী ১০,০০০
সিলেট ৭,০০০
মোট ৪২,০০০
উপসংহার: এ অঞ্চলে ত্রিপুরা জাতির অনেক অবদান রয়েছে। তারা অপরাপর আদিবাসীর ন্যায় প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম করে বাসযোগ্য ও চাষযোগ্য করে তুলেছিলো। এ জনগোষ্ঠী এ অঞ্চলে হাজার বছর ধরে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা সেখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধন ও সভ্যতা গড়ে তুলেছিলো। ত্রিপুরা মহারাজা বাংলা ভাষাকে ত্রিপুরা রাজ্যের রাষ্ট্র ভাষার স্বীকৃতি দিয়েছিলো। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে এ জাতির অসামান্য অবদান ছিলো। কিন্তু স্বাধীন এ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে আজ এই ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী নানান নিপীড়ন নির্যাতনের শিকার। আজ তারা প্রতিনিয়ত নিজ ভিটেমাটি ও পিতৃভূমি থেকে উচ্ছেদ হচ্ছে। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কারণে আজ তারা তাদের মাতৃভাষা ও পোষাক হারিয়ে ফেলতে বসেছে। এ গণতান্ত্রিক সভ্য দেশে এসবের অবসান হওয়া অত্যাবশ্যক। ত্রিপুরা আদিবাসীসহ বাংলাদেশের সকল আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতিসহ এদেশে তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা দরকার। তবেই এ দেশ একটি গণতান্ত্রিক ও সভ্য দেশ হিসেবে পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে।
শক্তিপদ ত্রিপুরা
সূচনা: ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের পাহাড় ও সমতল উভয় অঞ্চলে বসবাস করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা এবং সমতলের কুমিল্লা, চাঁদপুর, রাজবাড়ী, সিলেট, চট্টগ্রাম বিভাগের ফটিকছড়ি, মিরসরাই, ছোট কুমিরা, বড় কুমিরা, সীতাকুন্ডু প্রভৃতি এলাকায় বসবাস করে। সমতল এলাকার ত্রিপুরাদের জনসংখ্যা পঞ্চাশ হাজারের কাছাকাছি হবে। আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে একমাত্র ত্রিপুরা আদিবাসী পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সমতলের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এর প্রধান কারণ হলো এক সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম ও উল্লেখিত সমতলের অঞ্চলসমূহ ত্রিপুরা মহারাজার রাজ্যভূক্ত ছিলো। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সমতলের বিভিন্ন অঞ্চলে এখনো ত্রিপুরা মহারাজাদের স্থাপত্য কালের স্বাী হয়ে আছে। এগুলোর কোন কোন স্থাপত্য ইতোমধ্যে প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে আবার কোন কোনটি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের দখলে। আবার কোন কোনটি যত্নের অভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছে।
সার্বিক অবস্থা
সমতলের ত্রিপুরাদের সার্বিক অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। এ জনগোষ্ঠীর বেশীরভাগ পরিবার ভূমিহীন। ছলে বলে কৌশলে তাদের পিতৃভূমি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বেদখল করে নিয়েছে। এ জনগোষ্ঠীর স্বারতার হার অত্যন্ত কম। তাদের আর্থিক অবস্থা বিষম খারাপ। এ জনগোষ্ঠীর বেশীরভাগ লোক অন্যের নিকট শ্রমিক হিসেবে কাজ করে জীবন ধারণ করে। সমতলের কোন কোন অঞ্চলের ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর লোকেরা তাদের ভাষা ও পোষাক হারাতে বসেছে। চাঁদপুর ও কুমিল্লার ত্রিপুরা রমণীরা এখন নিজস্ব পোষাক 'রিনাই-রিসা' পরিধান করে না। তারা এখন শাড়ী ব্যবহার করে। কোন কোন অঞ্চলের কিছু কিছু ত্রিপুরাদের হাতে কিছু কিছু জমি রয়েছে। সেসব জমি হাতিয়ে নেয়ার জন্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ভূমি দস্যুরা নানান ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। এসব ভূমিদস্যুরা আদিবাসীদের বিরুদ্ধে হয়রানীমূলক মামলা রুজু করছে। এ মামলার কারণে আদিবাসীরা আর্থিক ও মানসিকভাবে তির শিকার হচ্ছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর মানুষ কর্তৃক আদিবাসী নারীরা প্রতিনিয়ত ধর্ষণ ও নানান ধরণের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। নানান ধরণের ষড়যন্ত্র ও প্রলোভনের আশ্বাস দিয়ে আদিবাসীদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করতে যাতে তারা আদিবাসীদের জমি হাতিয়ে নিতে পারে।
চাঁদপুর, কুমিল্লা, রাজবাড়ী
ভূমি- কুমিল্লার ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী তাদের ভিটেমাটি থেকে বার বার উচ্ছেদ হয়েছে। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট, বার্ড ও বন বিভাগ কর্তৃক তথাকথিত বনায়নের জন্য তাদের নিজ ভিটেমাটি ও পিতৃভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে।
চাঁদপুরের ত্রিপুরারাও বিভিন্ন কারণে তাদের ভিটেমাটি হারিয়েছে। ১৯৪৭ ও ১৯৭১ সালে তারা বেশী বেশী করে তাদের জায়গা জমি হারিয়েছে। ১৯৭১ সালে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে পালিয়ে গিয়েছিলো। ভারত থেকে ফিরে এসে তারা আর তাদের জায়গা ফিরে পায়নি। তাদের জায়গা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ভূমিদস্যুরা বেদখল করে নিয়েছে। বন্যা, ঘুর্নিঝড় ইত্যাদির কারণেও চাঁদপুরের ত্রিপুরারা তাদের জায়গা জমি হারিয়েছিলো। বর্তমানে চাঁদপুরের বেশীরভাগ মানুষ ভূমিহীন। এদের বেশীরভাগ দিনমজুর। কুমিল্লা ও চাঁদপুরের ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর লোকেরা প্রাতিষ্ঠানিক শিা গ্রহণ শুরু করেছে। একটি ুদ্র অংশের মাঝে শিা চেতনা এসেছে। তবে জনগোষ্ঠীর মাঝে এ শিা চেতনা সামগ্রিকভাবে আসেনি। শিা গ্রহণের েেত্র চাঁদপুর ও কুমিল্লার ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর জন্য অর্থনৈতিক সমস্যা একটি বড় সমস্যা। আর্থিক সমস্যার কারণে ত্রিপুরা আদিবাসী শিশুরা শিার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সরকার সবার জন্য শিা ঘোষণা করলেও কুমিল্লা, চাঁদপুর ও রাজবাড়ী এলাকার ত্রিপুরা আদিবাসী শিশুরা সরকারের এই কর্মসূচীর বাইরে থেকে যাচ্ছে। রাজবাড়ী এলাকার ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর লোকেরা নিরাপত্তার অভাব এবং নানান আগ্রাসন ও নির্যতনের কারণে এদের বেশীরভাগ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে চলে গেছে।
সীতাকুন্ডু, মীরসরাই ও কুমিরা
এসব অঞ্চলের ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর লোকেরা সবচেয়ে করুণ। এদের বেশীরভাগ বর্তমানে কেউ বন বিভাগের জায়গায় কিংবা অন্যের লীজকৃত ভূমিতে বসবাস করছে। অথচ বন বিভাগ ও ব্যক্তি মালিকানাধীন এসব ভূমি ত্রিপুরা আদিবাসীরাই বনের বাঘ-ভল্লুক ও নানা রকম জীবজন্তুর সাথে যুদ্ধ করে, বহু শ্রম ও ঘামের বিনিময়ে সেসব ভূমিকে চাষযোগ্য ও বাসযোগ্য করে তুলেছিলো। তারা এসব অঞ্চলে গ্রাম গড়ে তুলেছিলো। এসব অঞ্চল ছিলো তাদের চাষযোগ্য জুমভূমি। যুগ যুগ ধরে তারা সেসব ভূমির উপর জুমচাষ করে আসছিলো। ত্রিপুরা আদিবাসীদের সরলতার সুযোগে বন বিভাগ ও সে অঞ্চলের ভূমি দস্যুরা আদিবাসীদের জুমভূমি ও গ্রাম লীজ নিয়ে নেয়। প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে বহু ঘাম, শ্রম ও জীবনের বিনিময়ে যে জমিগুলিকে চাষযোগ্য ও বাসযোগ্য করে তুলেছিলো এবং যে জায়গায় এই আদিবাসীরা যুগ যুগ ধরে জুমচাষ করে আসছিলো ও গ্রাম গড়ে তুলেছিলো সেসব জায়গা বন বিভাগ ও ভূমিদস্যুরা মতা অপব্যবহার করে অন্যায়ভাবে আদিবাসীদের ভূমি কেড়ে নেয়। বর্তমানে এসব আদিবাসীরা তাদের ভোগদখলীয় জায়গায় চাষাবাদের জন্য এবং নিজ গ্রামে বসবাসের জন্য জমির মালিককে অর্থ দিতে হয় এবং জমির মালিক কম পারিশ্রমিকের বিনিময়ে গ্রামবাসীকে বাধ্যগতভাবে শ্রম খাটায়। এসব অঞ্চলের ত্রিপুরা আদিবাসীদের উপর আধুনিক দাসব্যবস্থা চালু রেখেছে জমির মালিকেরা। বর্তমানে মীরসরাই- এর একটি গ্রাম ভূমি দস্যুরা উচ্ছেদ করতে চাচ্ছে। সেসব ভূমিদস্যু ইদানীং আদিবাসীদের গ্রামসুদ্ধ জমি বন্দোবস্ত নিয়েছে বলে দাবী করছে। এভাবে বর্তমান সময়েও ভূমিদস্যুরা ত্রিপুরা আদিবাসীদের নিজ ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ত্রিপুরা আদিবাসীদের তাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করার নানা ধরণের মিথ্যা মামলা দিয়ে আর্থিক ও মানসিকভাবে হয়রানী চালিয়ে যাচ্ছে। এ ধরণের মামলা, হয়রানী ও শারিরীক আক্রমনের কারণে ইদানীং কুমিরা ও, সীতাকুন্ড ও মিরসরাই থেকে বেশকিছু পরিবার অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। এ অঞ্চলে ত্রিপুরা আদিবাসী নারীদের উপর চলছে নানান ধরণের নির্যাতন। এসব অঞ্চলে আদিবাসী নারীরা প্রায়শ:ই ধর্ষণের শিকার হন। সীতাকুন্ডু, কুমিরা ও মিরসরাই অঞ্চলে ত্রিপুরা আদিবাসীর জনসংখ্যা আনুমানিক----- হবে বলে এলাকাবাসী দাবী করে।
সিলেট
সিলেট অঞ্চলের ত্রিপুরা আদিবাসীরাও বার বার তাদের পিতৃভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়েছে। এই অঞ্চলে ইস্পাহানী চা কোম্পানীসহ বেশ কয়েকটি চা কোম্পানী ত্রিপুরা আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে যুগ যুগ ধরে ভোগ দখলকৃত জুমভূমির উপর চা বাগান সৃজন করে। বন বিভাগ কর্তৃকও ত্রিপুরা আদিবাসীরা উচ্ছেদের শিকার হয়। বন বিভাগ ত্রিপুরা আদিবাসীর হাজার হাজার একর জুমভূমি বেদখল করে সে অঞ্চলের বন ধ্বংস করে বনবাগান গড়ে তুলে। বর্তমানে সিলেট অঞ্চলের বেশীরভাগ ত্রিপুরা ভূমিহীন ও বর্তমান বন বিভাগের জায়গায় ফরেষ্ট ভিলেজার হিসেবে বসবাস করছে। এসব অঞ্চলে কোন স্কুল নেই। তাই এসব অঞ্চলে ত্রিপুরা আদিবাসী শিশুরা শিার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে। তথাপি কয়েকটি গ্রামে যারা নিজস্ব ভিটেমাটি ও জমি আছে তারা তাদের সন্তানদের পড়াশুনা করাচ্ছে। যেহেতু বেশীরভাগ মানুষের আর্থিক অবস্থা নাজুক, তাই বেশীরভাগ সন্তান শিার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ অঞ্চলেও ভূমিদস্যুরা ত্রিপুরা আদিবাসীদের জায়গা জমি কেড়ে নেওয়ার জন্য নানা ধরণের ষড়যন্ত্র ও হয়রানীমূলক অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। গ্রামের যারা একটু সচেতন ও সংগঠক তাদের বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যা মামলা দিয়ে অযথা হয়রানী করা হচ্ছে।
ইতিহাস ও ঐতিহ্য
কুমিল্লা শহরে ত্রিপুরা মহারাজাদের বহু ঐতিহাসিক নিদর্শন এখনো কালের সাী হয়ে আছে। ত্রিপুরা মহারাজার আমলে কুমিল্লার নামও 'ত্রিপুরা'। পাকিস্তান আমলে ত্রিপুরা- এর পরিবর্তে জেলার নাম 'কুমিল্লা' রাখা হয়। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টকে ঘিরে বর্তমানে যে বাজারটি ক্যান্টনমেন্ট মার্কেট নাম ধারণ করেছে পূর্বে সেই মার্কেটের নাম ছিলো 'টিপরা বাজার'। আশির দশক অবধি এই মার্কেটের নাম ছিলো 'টিপরা বাজার'। আশির দশক পরে বাজারের নাম পরিবর্তন করা হয় এবং এর নাম রাখা হয় 'ক্যান্টনমেন্ট মার্কেট'।
টিপরা বাজার থেকে কিছুদূর গেলে সাবের বাজার। সাবের বাজারের উত্তর-পশ্চিম দিকে রানী ময়নামতির প্রাসাদ। রানীর বাংলো ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। তবে সুস্পষ্ট চিহ্ন এখনো য়ে গেছে। মাটি অবধি ইটের দেয়াল এখনো বর্তমান। বিরাট এলাকা নিয়ে রানীর বাংলো নির্মিত। চারিদিক ইটের দেয়াল এখনো রয়ে গেছে।
বাংলোর ভেতরে এক সুড়ঙ্গ ছিলো বলে জানা যায়। তবে, সুড়ঙ্গ কতদুর গেছে এবং সুরঙ্গ দিয়ে বের হবার পথ কেউ বের করতে পারেনি। আগরতলার রাজপ্রাসাদেও সুরঙ্গ পথ ছিলো। আক্রান্ত হলে যাতে নিরাপদে রাজা-রানী বের হয়ে যেতে পারে। সরকার ময়নামতি রানীর বাংলোকে প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। এই বাংলোর সামনে বিশাল একটি মাঠ আছে। এই মাঠে প্রতি বছর মেলা বসে। তবে, বাংলোটি যথাযথ সংরণের অভাব রয়েছে। মেলা শেষ হলে মাঠে সারাদিন গরু ছাগলের অভয়ারণ্য হয়ে থাকে।
রানীর বালোর নীচে দুটি দীঘি রয়েছে। জনশ্রুতি আছে- ময়নামতি ছিলেন যেমনি অতীব অপরূপ সুন্দরী তেমনি ছিলেন বুদ্ধিমতী। রানী ময়নামতি ঘোষণা দিলেন- এক রাতের মধ্যে যে এক বড় দীঘি খনন করে দিতে পারবে তাকে তিনি বিয়ে করবেন। বহু দেশীয় রাজা চেষ্টা করলেন কোন রাজাই এক রাতের ভেতরে দীঘি খনন করে দিতে পারেনি। ঢেউ রাজা ছিল দৈত্য রাজা। তিনি তাঁর হাজার হাজার দৈত্যদের নিয়ে পুকুর খনন খনন শুরু করলেন। রানী ময়নামতি দেখলেন- দৈত্য রাজা কয়েক ঘন্টার মধ্যে পুকুর খনন শেষ করতে চলেছে। তিনি এক ফন্দি আঁটলেন। তিনি নিজেই মোরগ ঠিক যেমনি ডাক দেয় অনুরূপ ডাক দিলেন। দৈত্যরা মনে করলো- ভোর হয়ে এলো। পুকুর খনন শেষ করা যাবে না। তাই তারা কোদাল পরিস্কার করে চলে গেলো। যেখানে কোদাল পরিস্কার করা হলো সে জায়গাটিও একটি পুকুর হয়ে গেলো এবং তার নাম হলো কোদাল্যা দীঘি। ঢেউ রাজা কর্তৃক খননকৃত বলে অপর দীঘিটির নাম হলো ঢেউ দীঘি। এই হলো ঢেউ দীঘি ও কোদাল্যা দিিঘর ইতিহাস।
আজ থেকে ৫০০ বছর আগে ত্রিপুরা মহারাজা বর্তমান কুমিল্লা শহরের প্রাণ কেন্দ্রে মহারাজা ধর্ম মানিক্য রানীরকুঠি নির্মাণ করেছিলেন। মহারানী কুমিল্লা অবস্থানকালে যাতে সানন্দে অবকাশ যাপন করতে পারে সে ল্েয ত্রিপুরা মহারাজা ধর্ম মানিক্য এ কুঠি নির্মাণ করেছিলেন। ১৯৪৯ সাল অবধি ত্রিপুরা মহারানীগণ কুমিল্লায় আগমন করলে এ কুঠিতেই অবস্থান করতেন। মহারাজাদের শাসনামল থেকে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর লোকেরা কুমিল্লা অঞ্চলে বসবাস করে আসছে। এখনো বহু ত্রিপুরা গ্রাম আছে যারা বংশ পরম্পরায় যুগ যুগ ধরে কুমিল্লা জেলায় বসবাস করে আসছে। কুমিল্লা জেলার এ ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী তাদের জায়গা জমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে বর্তমানে কঠিন বাস্তবতায় দিনাতিপাত করছে। ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করে কুমিল্লার বর্তমান বার্ড ও ক্যান্টনমেন্ট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এভাবে কুমিল্লার বেশীরভাগ ত্রিপুরা পিতৃভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে বর্তমানে ভূমিহীন অবস্থায় মানবেতর জীবন যাপন করছে।
কুমিল্লার ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী শিা-দীা ও অর্থনীতিতে খুবই অনুন্নত। অথচ ত্রিপুরা মহারাজারা কুমিল্লার সকল ধর্মের ও জাতির শিা, ভাষা ও সাহিত্য উন্নয়নে বহু উন্নয়নমূলক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। ত্রিপুরা মহারাজারা মধ্য যুগ থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য উন্নয়নে বহুভাবে ভূমিকা পালন করেছিলেন। সে সময়কালে রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর ও জগদীশ চন্দ্র বসুসহ বহু সাহিত্যিক ও গবেষক এবং শিা প্রসারের বহু উদ্যোগকে ত্রিপুরা মহারাজারা ফি বছর সহযোগিতা প্রদান করেছিলেন। সেই শিা ও সাহিত্য অনুরাগী অসাম্প্রদায়িক মহারাজাদের বংশধর কুমিল্লায় বসবাসকারী ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর লোকেরা আজ তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি হারাতে বসেছে। তাদের অস্তিত্ব আজ বিপন্ন। তাদের জায়গায় বহু উন্নয়ন হয়েছে; কিন্তু, এ জনগোষ্ঠীর কোন উন্নয়ন ঘটেনি।
আজ কুমিল্লার ত্রিপুরা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষা, সংস্কৃতি ও অস্তিত্ব ধ্বংসের পথে। কুমিল্লার আদিবাসীদের নামে যেসব বরাদ্ধ হয় তা অনেক সময় অ-আদিবাসীদের নামে প্রদান করা হয়। বাংলাদেশের ত্রিপুরা আদিবাসীদের ঐতিহ্য ও ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহ বিগত সময়ে সরকারের অবহেলার কারণে কোনটি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দখল করে নিয়েছিলো আবার কোনটি ধ্বংস প্রাপ্ত হয়েছিলো। আমরা বর্তমান সরকারের কাছে দাবী জানাই যাতে সরকার বাংলাদেশে ত্রিপুরা আদিবাসীদের যে সব ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রয়েছে সে সব নিদর্শন সংরণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ত্রিপুরা মহারাজাদের নির্মিত কুমিল্লার ঐতিহাসিক নিদর্শনসমূহ দেশের জাতীয় সম্পদ। এ ঐতিহাসিক জাতীয় সম্পদ সংরণে জাতির দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। এসব ঐতিহাসিক নিদর্শন সংরণ করা গেলে দেশের ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ সমৃদ্ধি হবে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ২৪ অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে " বিশেষ শৈল্পিক কিংবা ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্পন্ন বা তাৎপর্যমন্ডিত স্মৃতি নিদর্শন, বস্তু বা স্থান সমূহকে বিকৃতি, বিনাশ বা অপসারন হইতে রা করিবার জন্য রাষ্ট্র ব্যবস্থা গ্রহন করিবেন''। তাহলে কেন রানী কুঠির সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের নিকট হস্তান্তর হবেনা?
এসব ঐতিহাসিক নিদর্শন ছাড়াও কুমিল্লা শহরে ত্রিপুরা মহারাজাদের বহু প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ রয়েছে। এগুলো হলো- ১. বীরচন্দ্র গণ পাঠাগার ও নগর মিলনায়তন, ২. শাহসুজা মসজিদ, ৩. ত্রিপুরা ব্রম্ম মন্দির, ৪. রাজবাড়ী, ৫. শ্রী শ্রী রাজ রাজেশ্বরী মন্দির, ৬. দীঘি
ত্রিপুরা ব্রম্ম মন্দির ত্রিপুরা মহারাজা কর্তৃক নির্মিত একটি সনাতনী মন্দির। ১৯২৩ খ্রী: এই মন্দিরটি নির্মিত বলে জানা যায়। এটি বর্তমানে কুমিল্লা শহরের বাদুরতলায় অবস্থিত।
শাহসুজা মসজিদ বর্তমানে কুমিল্লা শহরের মোঘলতলীতে অবস্থিত। বহু মোঘল সম্রাটের সাথে ত্রিপুরা মহারাজার যুদ্ধ সংঘটিত হলেও সম্রাট শাহ সুজার সাথে ত্রিপুরা মহারাজার সম্পর্ক স্থাপিত হয়। বন্ধুর নিদর্শন স্বরূপ ত্রিপুরা মহারাজা এই শাহ সুজা মসজিদ নির্মাণ করেন।
কুমিল্লার ত্রিপুরা রাজার 'রাজবাড়ী' বর্তমানে 'কুমিল্লা জেলা ভূমি অফিস' হিসেবে ব্যবহ্নত হচ্ছে। এলাকার মানুষের কাছে এটি এখনো রাজবাড়ী হিসেবে পরিচিত। কুমিল্লা জেলা সাইবোর্ডে লেখা আছে রাজবাড়ী কম্পাউন্ড অর্থাৎ এই জায়গাটি এখনো রাজবাড়ী কম্পাউন্ড হিসেবে পরিচিত।
'শ্রী শ্রী রাজ রাজেশ্বরী কালী মন্দির' কুমিল্লা শহরের মনিহরপুরে অবস্থিত। ত্রিপুরা মহারাজ রত্ন মানিক্য ১১১৩ ত্রি: / ১৭০২ খ্রী: এই মন্দির নির্মাণ করেন।
'বীরচন্দ্র গণ পাঠাগার ও নগর মিলনায়তন' ১৮৮৫ খ্রী: নির্মিত। মহারাজা বীরচন্দ্র মানিক্য কর্তৃক নির্মিত বলেই এই গণ পাঠাগার ও নগর মিলনায়তনের নামকরণ হযেছে- বীরচন্দ্র গণ পাঠাগার ও নগর মিলনায়তন। এটি কুমিল্লা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত। কুমিল্লা জেলায় ত্রিপুরা রাজাদের এ ধরণের বহু ঐতিহাসিক স্থাপত্য রয়েছে।
সিলেটের শ্রীমঙ্গল শহরের ৫ কিলোমিটার দুরে নির্মাই শিবমন্দির ও এক বড় দীঘি আছে। এই শিব মন্দির ১৪৫৪ খ্রীষ্টাব্দে নির্মান করা হয়। ত্রিপুরা মহারাজা এই নির্মাই শিব মন্দিরটি নির্মাণ করেন ও মন্দিরের পার্শ্বস্থ দিিঘ খনন করেন সাধারণ জনগণের সুবিধার্থে।
নির্মাই শিব মন্দিরের ইতিহাস এই- ত্রিপুরা মহারাজার বিরুদ্ধে কখনো কখনো কুকি সামন্ত রাজা বিদ্রোহ ঘোষণা করতো। এরকম এক কুকি বিদ্রোহের সংবাদ পেয়ে একদল সৈন্য পাঠান কুকি বিদ্রোহ দমন করতে। তুমুল এ যুদ্ধে কুকিরা পরাজিত হলেও ত্রিপুরা রাজার সেনাপতি যুদ্ধেেত্র মারা যান। বিয়ের অল্প ক'বছরের মধ্যে স্বামী হারা হন রাজকন্যা নির্মাই। তখনকার দিনে ভারতবর্ষে সহমরণ প্রথা চালু ছিল। রাজকন্যা নির্মাই সহমরণে রাজি হননি। বরং তিনি যে স্থানে স্বামী মারা গেছেন সেস্থানে শিবের আরাধনা শুরু করেন। এ আরাধনায় তিনি সিদ্ধিলাভ করেন। ত্রিপুরা মহারাজা রাজকন্যা নির্মাই- এর এ আরাধনাকে স্মরণীয় করে রাখার ল্েয এ স্থানে শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন এবং মন্দিরের পাশে খনন করেন এক বিরাটকায় দীঘি।
সমতল এলাকার ত্রিপুরাদের আনুমানিক জনসংখ্যা
অঞ্চলের নাম জনসংখ্যা
ফটিকছড়ি অঞ্চল ১৫,০০০
কুমিরা, সীতাকুন্ডু ও মিরসরাই ১০,০০০
কুমিল্লা, চাঁদপুর ও রাজবাড়ী ১০,০০০
সিলেট ৭,০০০
মোট ৪২,০০০
উপসংহার: এ অঞ্চলে ত্রিপুরা জাতির অনেক অবদান রয়েছে। তারা অপরাপর আদিবাসীর ন্যায় প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম করে বাসযোগ্য ও চাষযোগ্য করে তুলেছিলো। এ জনগোষ্ঠী এ অঞ্চলে হাজার বছর ধরে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা সেখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধন ও সভ্যতা গড়ে তুলেছিলো। ত্রিপুরা মহারাজা বাংলা ভাষাকে ত্রিপুরা রাজ্যের রাষ্ট্র ভাষার স্বীকৃতি দিয়েছিলো। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে এ জাতির অসামান্য অবদান ছিলো। কিন্তু স্বাধীন এ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে আজ এই ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী নানান নিপীড়ন নির্যাতনের শিকার। আজ তারা প্রতিনিয়ত নিজ ভিটেমাটি ও পিতৃভূমি থেকে উচ্ছেদ হচ্ছে। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কারণে আজ তারা তাদের মাতৃভাষা ও পোষাক হারিয়ে ফেলতে বসেছে। এ গণতান্ত্রিক সভ্য দেশে এসবের অবসান হওয়া অত্যাবশ্যক। ত্রিপুরা আদিবাসীসহ বাংলাদেশের সকল আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতিসহ এদেশে তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা দরকার। তবেই এ দেশ একটি গণতান্ত্রিক ও সভ্য দেশ হিসেবে পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে।